রক্তজবা
-চিন্ময় মহান্তী
মেয়েটার নাম জবা। বাবা আদর করে ডাকেন রক্তজবা। যদিও মেয়েটার নামের সঙ্গে গায়ের রঙের কোনো সাযুজ্য নেই, ছিল না, মেয়েটার গায়ের রঙ কালো একেবারে মিশমিশে কালো। কত সম্বন্ধ এলো, গরীব বাপ ভুরিভোজের আয়োজনও করলেন, কিন্তু সবাই পরে খবর দেবো বলে আর খবর দিল না! মেয়েটা বাতায়নে চেয়ে চেয়ে অদৃষ্টকে খুঁজতে চেষ্টা করলো হঠাৎ তার জীবনে একটা ফাগুনী পূর্ণিমা এলো। হুইল চেয়ারে বসা একটা ছেলে এলো জবাকে দেখতে মেয়েটার বাবার পছন্দ হলো না। ছেলেটা বলল- জবা আমি তোমাকে পছন্দ করি কিন্তু তোমাকে তো উপার্জন করে খাওয়াতে পারবো না, তুমি কি এসব জেনে আমাকে বিয়ে করবে?
জবার চোখে জল এলো, আঁখি দুটি হলো রক্তজবা।মেয়েটা বাবাকে কাছে ডেকে বলল- বাবা আমি ভালবাসা খুঁইজ্যা পাইছি বাবা! বাবা ইতস্তত হয়ে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে বললেন- ওর সঙ্গে তোর জীবনটাকে জ্যুইড়লে তোরে অনেক অনেক সংগ্রাম কইরতে হবে মা।
-আমি পাইরব বাবা আমি পাইরব! ভালবাসার জইন্যে আমি সব পাইরব!
সাতপাক পেরিয়ে, পেরিয়ে গেল দু’টো বছর । হুইল চেয়ারে বসা স্বামীর সঙ্গে কাটিয়ে দেওয়া দু’টো বছর, বুটিকের কাজ করে কাটানো দু’টো বছর পেরিয়ে গেল।কালো মেয়ের তকমাটা আজ খুঁজে ফেরে পাড়াময়, খুঁজে পায় না মেয়েটাকে, খুঁজে পায় একটা উন্নতিশীলা জবাকে, খুঁজে পায় একটা প্রেরণাদায়িনী জবাকে।মেয়েটা একটা বুটিকের কারখানা খুলেছে নাম দিয়েছে রক্তজবা। যেদিন তার কারখানার উদ্বোধন হলো,গরীব বাপটা এসে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে বললেন- তুই আমার রক্তজবা-মা।
হুইল চেয়ারে বসা মেয়েটার ভালবাসার চোখে সেদিন ছিল ঝরে পড়া মুক্তার মতো আনন্দাশ্রু,
মেয়েটার জীবনে আর অমাবস্যা আসেনি এসেছে শুধুই ফাগুনী পূর্ণিমা আর পূর্ণিমা। আজ জীবনের মধ্য গগনে এসে মেয়েটার মনে পড়ে ওর বাপের গাঁয়ের সুলতা পিসির কথা! পিসিটা বিধবা হয়ে ঘাঁটি গেড়েছিল বাপের ঘরে মেয়েটাকে দেখলেই বলতো- এমন কালো মাইয়ারে বিয়া কইরবেক কোন মাইনসে? তোর বিয়েই অবে না, আইবুড়া অইয়া বাপের বোঝা অইয়া তরে থাকা লাইগব। মেয়েটার আজ সুলতা পিসির কাছে গিয়ে বলতে ইচ্ছা করে, মাইনসে নয়গো পিসি আমি ভালবাসা পাইছিগো ভালবাসা পাইছি। পিসিটা নেই, আকাশে তারা হয়ে গেছে মেয়েটার মা যেমন সেই ছোটবেলায় তারা হয়ে গেছিল তেমনই বোধ হয় তারা হয়ে গেছে। সেদিন তুলসীতলায় মাকে দেখে মেয়েটা যখন কাঁদছিল তখন ওর বাপই বলেছিল- তর মা তারা অইয়া গেছে ।
মন খারাপের রাতে আজও মেয়েটা তাকিয়ে থাকে তাকিয়ে থাকে তারা ভরা আকাশটার দিকে। কিন্তু, কোনটা যে তার মা তা খুঁজে পায় না। হুইল চেয়ারে বসা ভালবাসা তখনি পিছন থেকে বলে- রানী, এভাবে মাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। জবা তখন ভালবাসার বুকে নিজের বুকটা গুঁজে দিয়ে হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠে, এই বুকেই সে খুঁজে পায় পরম শান্তি, নিখাদ ভালবাসা ।